দেশের শেয়ারবাজারে আবার বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। কয়েক দিন ধরে অস্বাভাবিকভাবে শেয়ারের দাম কমছে। তবে এমন দরপতনের কোনো যৌক্তিক কারণ নেই বলে জানিয়েছেন শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টরা।
শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, গত বছরের মার্চে বড় দরপতন হওয়ার কারণ ছিল। তখন করোনা ভাইরাস মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ায় অর্থনৈতিক কার্যক্রম কমতে থাকায় বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত ছিলেন। এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। টিকা প্রদান শুরু হওয়ায় করোনা মহামারী থেকে উত্তরণে দৃশ্যমান অগ্রগতি আছে এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রমও প্রায় স্বাভাবিক ধারায়। বিএসইসির নতুন নেতৃত্বে আস্থা বাড়ায় বিনিয়োগও বাড়ছে। সব কিছু যখন প্রায় স্বাভাবিকের পথে, তখন গত কয়েক দিনের টানা এ দরপতনের কারণ নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। একে অস্বাভাবিক বলে মনে করছেন তারা। মাত্রাতিরিক্ত আইপিও অনুমোদন, হঠাৎ করেই প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়া এবং মার্কেটের প্লেয়ারদের নেতিবাচক আচরণেই বর্তমান পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
বাজারসংশ্লিষ্টরা জানান, অজ্ঞাত কারণে বড় কিছু কোম্পানির শেয়ারদর কমছে, যা সূচক পতনের বড় কারণ। এ সময়ে অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাওয়া কিছু শেয়ারের দর কমছে। তবে অন্য শেয়ারগুলোর দর কমার কারণ নেই। হয়তো সূচকের নিম্নমুখী ধারা দেখে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা নতুন করে দরপতনের মনস্তাত্ত্বিক ভীতি থেকে শেয়ার বিক্রি করছেন। এটাই পতনকে উসকে দিচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তারা।
বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত দুদিনে ডিএসইর বাজার মূলধন কমেছে ২১ হাজার কোটি টাকা। আর সূচক কমেছে ২৭১ পয়েন্ট। ডিএসইর সব ধরনের সূচক ২ শতাংশের বেশি কমে মাসের সর্বনিম্ন পর্যায়ে চলে এসেছে। এর আগে গত ২৯ ডিসেম্বর ডিএসইর সার্বিক সূচক ৫ হাজার ৩৫৮ পয়েন্ট ছিল।
বাজার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, আগের দিনের বড় ধসের ধারাবাহিকতায় সোমবারেও শেয়ারবাজারে লেনদেনের শুরু থেকেই ব্যাংক, বীমা, প্রকৌশল, বস্ত্র, ওষুধ, আর্থিক খাতসহ প্রতিটি খাতের বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ারের দাম কমতে থকে। সেই সঙ্গে দরপতন হয় মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, বেক্সিকো, বেক্সিমকো ফার্মা, লংকাবাংলা ফাইন্যান্স ও লাফার্জ হোলসিমের মতো বড় মূলধনী কোম্পানির দর আশঙ্কাজনকভাবে কমতে থাকে।
গতকাল দিনভর অস্থিরতার কারণে ডিএসইতে লেনদেনে অংশ নেওয়া মাত্র ২৩টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম বেড়েছে। এর বিপরীতে দাম কমেছে ২৩৬টির। আর ৯১টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।
বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের দরপতন হওয়ায় ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক আগের দিনের তুলনায় ১২৮ পয়েন্ট কমে ৫ হাজার ৩৭৬ পয়েন্টে নেমে গেছে। আগের দিন সূচকটি কমে ১৪২ পয়েন্ট। অর্থাৎ টানা দুই কার্যদিবসের বড় পতনে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক কমল ২৭০ পয়েন্ট।
অন্য দুই সূচকের মধ্যে ডিএসই-৩০ আগের দিনের তুলনায় ৬৭ পয়েন্ট কমে ২ হাজার ২৩ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। আর ডিএসইর শরিয়াহ সূচক ২০ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ২১৪ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের দরপতন হওয়ায় ডিএসইর বাজার মূলধন কমেছে ১০ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা। দিনের লেনদেন শেষে ডিএসইর বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৫৮ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা, যা আগের দিন ছিল ৪ লাখ ৬৯ হাজার ৬৯ কোটি টাকা। বাজার মূলধন কমার অর্থ তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার ও ইউনিটের দাম সম্মিলিতভাবে ওই পরিমাণ কমেছে।
অন্য শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের সার্বিক মূল্যসূচক সিএএসপিআই কমেছে ৩৯৬ পয়েন্ট। বাজারটিতে লেনদেন হয়েছে ৩৮ কোটি ১১ লাখ টাকা। লেনদেনে অংশ নেওয়া ২২৮টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৬টির দাম বেড়েছে। বিপরীতে কমেছে ১৭৬টির এবং ৩৬টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।
বাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ দেশ’কে বলেন, বাজার যে ধরনের আচরণ করছে, তা কোনোভাবেই স্বাভাবিক বলা যাবে না। বাজারে সূচকের ওঠানামা থাকবে। তবে যেভাবে পতন তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। এ সময় তিনি রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক ও আইসির ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। তবে বাজার কারসাজির সঙ্গে যুক্তদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন তিনি।
এ বিষয়ে ডিএসই ব্রোকারেজ অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট শরীফ আনোয়ার হোসেন দেশ’কে বলেন, বাজারের অস্বাভাবিক আচরণের যৌক্তিক কোনো কারণ নেই।
সূত্র জানিয়েছে, বাজারের অস্বাভাবিক আচরণ নিয়ে গতকাল জরুরি বৈঠক করে বিএসইসি। বৈঠকের ব্যাপারে শরীফ আনোয়ার বলেন, বাজারে মনিটরিং ও সার্ভিল্যান্স বাড়ানোর বিষয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে।
বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র রেজাউল করিম দেশ’কে বলেন, কমিশনের তরফ থেকে বর্তমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। বাজারে কেউ কারসাজি করে শেয়ারদর কমানোর চেষ্টায় আছে কিনা, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে।
কোনো প্রাতিষ্ঠানিক বা ব্যক্তি বিনিয়োগকারী অযথা শেয়ার বিক্রির চাপ তৈরি করে বাজারকে পতনের দিকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করলে তাৎক্ষণিক তথ্য নেওয়া হচ্ছে। এ জন্য বিএসইসি ও ডিএসইর সার্ভিল্যান্স দল লেনদেনের পুরো সময় নজরদারির কাজ করবে।