কফি পান করতে করতে জানতে চাইলাম শিশু শ্রমিকদের কথা। শুনেছিলাম শিশুদের দিয়ে কঠিন কঠিন কাজকর্ম করিয়ে নেয়া হয়। তার মধ্যে হলো কার্পেট বোনা’র কাজ। দীর্ঘ ১০ থেকে ১২ ঘন্টা এই কোমলমতি শিশুরা নরম আঙ্গুল দিয়ে কার্পেট বুনতে থাকে মাসের পর মাস। একেকটি কার্পেট তৈরী হতে সময় লেগে যায় ২ থেকে ৩ মাস পর্যন্ত। শিশুদের অল্প বেতন দিয়ে এ কাজটি করিয়ে নেয়া হয়। শুনেছি অনেক সময় কোনো টাকা পয়সা দেয়া হয় না – শুধু খাবারের ব্যবস্থা থাকে।
ইভা মাথা নেড়ে বললো সঠিকই শুনেছ। এটি একটি করুণ বেদনার কাজ একটি শিশুর জন্য। বড় হয়ে তাদের অনেকেরই আঙ্গুল গুলো অকেজো হয়ে যায় – কারণ কার্পেট বুনতে যে দীর্ঘ সময় হাতের আঙুলের উপর প্রেসার পরে তাতে রক্ত চলাচল কমতে থাকে এবং একপর্যায়ে অকেজো হয়ে যায়।
ইভার কথা গুলো মনে হচ্ছিলো কত দরদ মেশানো- কত তথ্যবহুল। তুমি হয়তো জানো পাকিস্তানে বর্তমানে ৫০০,০০০ শিশু রয়েছে যারা অভ্যন্তরীন সংঘাত এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য বাস্তুচ্যুত হয়েছে। তাছাড়া আফগানিস্তান থেকে এসেছে আরও ১ মিলিয়ন শরণার্থী।
এদেশে শিশুরা মোট জনসংখ্যার ৪৮% এর বেশি। শিশু মৃত্যুর হার অনেক বেশি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৪ জন শিশুর মধ্যে ১ জন ৫ বছর বয়স হওয়ার আগেই মৃত্যূ বরণ করে যা নাকি আমেরিকার তুলনায় ১০ গুন বেশি। অনুমানিক ৩৮ % শিশুরা পুষ্টি হীনতায় ভুগছে। প্রায় ৩৫% শিশুরা স্কুলে যেতে পারেনা। ৫৩ % মেয়েরা লেখা পড়ার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত।
তাছাড়া বাল্যবিবাহ প্রথা এখনো প্রচলিত। যদিও আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পাঠানমুলুকে আইনের শাসনের চেয়ে সামাজিক ও ধর্মীয় প্রথাকে প্রাধান্য দেয়া হয়। এই দেশে ১৪ % মেয়েদের ১৫ থেকে ১৯ বছরের মধ্যে বিয়ে হয়ে যায়।
ইভা একটু থেমে আমাকে জিজ্ঞেস করলো তুমি জানতে চাও বাংলাদেশের শিশুশ্রমিকদের অবস্থা? যদিও আমার একেবারেই এবংজানা নয় – তবুও মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম।
এল ও ইউনিসেফ এর তথ্য অনুযায়ী ২০০৬ সালে বাংলাদেশে ৫ থেকে ১৭ বছরের আনুমানিক ৫.১ মিলিয়ন শিশুরা দারিদ্র সীমার নিচে জীবন যাপন করছে। জীবিকার তাগিদে শ্রমজীবী হতে বাধ্য হচ্ছে। ২০০৬ সালে ১২ বছরের কম বয়সের নিচে ১.৩ মিলিয়ন শিশু শ্রমজীবী এবং ১২ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে ১.৭ মিলিয়ন শিশুরা বিভিন্ন ধরণের পেশায় নিয়োজিত ছিল। এছাড়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ১৫ থেকে ১৭ বছরের প্রায় ২ মিলিয়ন শিশুরা বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কর্মস্থলে কাজে করে।
দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনে ইভা কথা থামিয়ে উঁকি দিলো। দেখলাম আমার দেহরক্ষী ও গাড়ি চালক বিসমিল্লাহ খানের বিশাল দেহটি দেখা যাচ্ছে ।অনুমতি পেয়ে ভিতরে এসে বললো স্যার আপনার আরেকটি মিটিং এটেন্ড করতে হবে। সময় গড়িয়ে গেছে অনেক। রাস্তায় ইতিমধ্যেই ভিড় হতে শুরু করেছে। ইভা বললো তোমার স্যারকে আর আটকে রাখছিনা। আজ আমাদের এই ব্রিফিং এখানেই শেষ করছি। তুমি বাইরে অপেক্ষা করো।
ইভা’কে ধন্যবাদ জানাতে হাত বাড়িয়ে দিলাম। কিন্তু না – মেয়েটি সেদিকে তোয়াক্কা না করে আলিঙ্গন করলো। আমি ভেবেছিলাম পাঠানমুলুকে থেকে অনেক কিছুই ভুলে গেছে ইভা। আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। না, শেকড় ও শেকড়ের সামাজিকতা ও সংস্কৃতির বহমান শ্রোতের টান – কেউ ভুলেনা কোনোদিন।
আলিঙ্গন মুক্ত করে বললো অনেকদিন পর আমার মাতৃভাষা সুইডিশে তোমার সাথে কথা বলে খুব আনন্দ পেলাম।
বিদায় নিয়ে গাড়িতে বসতেই বিসমিল্লাহ খান বললো , ইভা ম্যাডাম খুব ভালো একজন মানুষ। অনেকদিন থেকে এখানে কাজ করছেন, তাই চিনি। একটু দম নিয়ে বললো, দেখতেও খুব রূপসী। বিসমিল্লাহ খানের কথা শুনে তো আমি আকাশ থেকে মাটিতে পড়ার অবস্থা। বেটা বলে কি? সব সুন্দরীদের দিকে ওর নজর পড়বেই দেখছি।
কথা না বাড়িয়ে মাথা নেড়ে সম্মতি জানানোই এক্ষেত্রে নিরাপদ মনে হলো।
পিচঢালা পথ দিয়ে ছুটে চলেছি আর এক নতুন গন্তব্যে। ইভা’র শেষ কথাগুলো নিয়ে গেলো আমায় সেই ৫২’র ভাষা আন্দোলনের উত্তাল দিনে। বলা হলোনা ইভা’ কে মাতৃভাষায় কথা বলে তুমি যে আনন্দ পেলে আজ – ঠিক সেই আনন্দ পাওয়ার জন্য মাতৃভাষা বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করতে বুকের রক্তে ভাসিয়েছে যে জাতি – আমি তাদেরই একজন।
বিসমিল্লাহ খান খুব মনোযোগ দিয়ে ড্রাইভ করছে। খুব চুপচাপ আজ। আমি যা ভাবছি সেও কি একই ভাবনায় মশগুল? নাকি এখনো ইভা ম্যাডামের কথাই ভাবছে – কে জানে। ওকে আর বিরক্ত না করে আমার নিজস্ব ভাবনার সাগরে ডুব সাঁতার কাটাই শ্রেয় মনে হলো আপাতত।
শান্তিতে নভেল পুরুস্কার প্রাপ্ত নেলসন ম্যান্ডেলার শিশুদের নিয়ে একটি মর্মস্পর্শী উক্তি স্মরণে এলো। “There can be no keener revelation of a society’s soul than the way in which it treats its children.” সচেতন সমাজ গঠনের দূরদর্শী নির্দেশনা ।
স্কুল জীবনের কিছু স্মৃতিও মানসপটে ভেসে উঠলো। আমার ছোট চাচা তখন গ্রেট ইস্টার্ন ইন্সুরেন্স কোম্পানির চেয়ারম্যান। কোম্পানির একটি প্রোফাইল তৈরী করবেন – সেখানে সংযোজিত হবে বিভিন্ন ইন্সুরেন্স পলিসিগুলোর কার্যকারিতার কথা। সেখানে লিখলেন ” ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুদের অন্তরে “। আজকের শিশু আগামীদিনের ভবিষ্যৎ। তাই শিশুদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য এখনই সঞ্চয় করুন।
আজ যদি আমরা শিশুদের গড়ে উঠার সময় স্বাভাবিক জীবন ধারা থেকে বঞ্চিত করি- যদি তাদের শিশুকালীন বয়সে শ্রমিক, সোলজার, আর উঠের জকি বানাই তবে একদিন নৈতিকতার কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বিধাতার কাছে জাবাব দেবার কিছুই থাকবে না।
শিশুদের জন্য মানসিক, শারীরিক, সামাজিক বা নৈতিকভাবে বিপজ্জনক এবং ক্ষতিকারক এমন কাজকে পরিহার করতে যদি আমরা সফল না হই- তাহলে দেশ ও জাতিকে বঞ্চিত করা হবে – একটি জাতিকে পঙ্গু করে দেয়া হবে – কথাগুলো বলছিলো ইভা লুন্ডবার্গ কি আবেগ আর অনুভূতি নিয়ে।
বিসমিল্লাহ খানের কথায় ভাবনা থেকে ফিরে এলাম বাস্তবে। বললো, স্যার আমি কিন্তু ঠিক করে ফেলেছি ডাক্তার সাহেবার জন্য কি উপহার কিনতে হবে। বিসমিল্লাহ খানের কথায় চমকে উঠলাম। এতক্ষনে বুঝতে পারলাম পাঠান সেই অনেকক্ষন থেকে এত চুপচাপ কেন। ডাক্তার সাহেবাকে নিয়ে উনি ছিলেন চিন্তায় মশগুল। এই বিশাল শরীরের অধিকারী পাঠানের অন্তরটা যে একটি ছোট্ট শিশুদের চেয়ে কোমল উষ্ণতায় ভরা বুঝতে আমার আর অবকাশ থাকলোনা। বললাম, বলেই ফেলো কি উপহার কিনতে হবে? পাঠানের ঠোটের কোনায় এক রহস্যময় হাঁসির আভাস লক্ষ করলাম। বললো, স্যার উপহার কেনার জায়গায় গিয়ে দেখিয়ে দেব। পাঠানরা যে রহস্য করতে পারে সেটারও অভিজ্ঞতা হলো। ভাবলাম বেটাতো বেশ রসিক। কঠিন শিলাপাহাড় আর উপত্যাকার উত্তাপে আর ঝলসানিতে বেড়ে উঠা এই আফগান পাঠান কোথা থেকে পেলো মানবতার এই যাদুরকাঠি – ভাবতে ভাবতে পৌঁছে গেলাম আমার গন্তব্যস্থলে।
পৌঁছে গেলাম পেশাওয়ারে অবস্থিত সুইডিশ আফগানিস্তান কমিটি নামের এন জি ওর অফিসে। ওখানে দেখা হবে আফগানিস্তানের সাংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ করার জন্য এক নিবেদিত প্রাণ ন্যানসি হ্যাচ ডুপ্রির সাথে। যাকে পরিচয় করিয়ে দিতে কোনো উপমা দিতে হয়না। যিনি সর্ব পরিচিত শুধু আফগানিস্তানে নয় সারা বিশ্বে “আফগানিস্তানের দাদি ” নামে।
কান্ট্রি ডিরেক্টর আন্ডার্স ফেঙ্গের সাথে কুশল বিনিময় শেষ করে আফগানিস্তানের সাংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ করার জন্য এক নিবেদিত প্রাণ ন্যান্সি হ্যাচ ডুপ্রির সাথে কথা বলতে শুরু করলাম।
আফগানিস্তানের ইতিহাস, শিল্প ও প্রত্নতত্ত্ব সম্পর্কে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিশেষজ্ঞ ন্যানসি হ্যাচ ডুপ্রি আফগানিস্তানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সংরক্ষণের জন্য জীবনকালক উৎসর্গ করেছেন। মিসেস ডুপ্রি তার প্রথম স্বামী আমেরিকান কূটনীতিকের সাথে কাবুল এসেছিলেন। সেখানে এসে প্রেমে পড়ে যান – কেবল আফগানিস্তানের সাথেই নয়, প্রখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক এবং আফগানিস্তানের সংস্কৃতি ও ইতিহাসের পণ্ডিত লুই ডুপ্রির সাথে। মিসেস ডুপ্রি আফগান ট্যুরিস্ট অর্গানাইজেশনের জন্য পাঁচটি গাইডবুক লিখেছেন। সমস্ত বড় বড় প্রত্নতাত্ত্বিক এবং ঐতিহাসিক স্থানের পাশাপাশি জাতীয় জাদুঘরের গাইড ও তৈরী করেছেন এই মহিয়সী নারী।
আফগানিস্তানের ইতিহাস, ঐতিহ্য শিল্পকলা ও প্রত্নতত্ত্ব সংগ্রহ ও সংরক্ষণে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিশেষজ্ঞ ন্যান্সি হ্যাচ ডুপ্রি তাঁর জীবনের ৫০ বছরেরও বেশি সময় উত্সর্গ করেছিলেন। ১৯৬২ সালের এক ভরা দুপুরে কাবুলের উষ্ণ মাটিতে পা রেখেছিলেন এই কিংবদন্তি মহিয়সী। তার প্রয়াত স্বামী লুই ডুপ্রি ছিলেন একজন প্রখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক এবং আফগানিস্তানের সংস্কৃতি ও ইতিহাসের পণ্ডিত। দুজনে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন পরিচালনা করে ঘুরে বেরিয়েছেন আফগানিস্তানের সর্বত্র – মাঠে বন্দরে পাহাড়ে পর্বতে অবিরাম নিরন্তর।