কুড়ি ফর্মার মোটা সোটা স্মরণিকাটি আমার ছোটবেলার বয়ম ভর্তি গোটা লেবুর আচার। যত পুরোনো হবে তত মজা। রয়ে সয়ে রসিয়ে খাওয়ার তৃপ্তি। এই স্মরণিকার পাতায় পাতায় বন্দি রয়েছে আমার কৈশোর এবং কৈশোরের বন্ধুরা। জীবনের লম্বা সফরের অন্তিমে এসে ছেলে কিংবা মেয়ে—সবাইকে বন্ধু বলে জড়িয়ে ধরতে আজ কোন দ্বিধা নেই। ভয় নেই পাছে লোকে কিছু বলে।
বিষের বরষের অন্তিম দিন পেরিয়ে আজ বছরের নতুন দিন। মন্ট্রিয়লে সম্পুর্নভাবে লক ডাউন। রাস্তায় লোকজন নেই বলা যায়। এটাই সুযোগ স্মরণিকার গভীর সায়রে ডুব দেয়ার। ডাইভ দিয়ে চলে গেলাম ইক্কিবারে সত্তরে।
তখনকার দিনে পত্রিকার সাহিত্য পাতায় ততটা সাচ্ছন্দে বন্ধু পাতানো যেতো —— সাহিত্য সভায় বা কোন সাহিত্যের আসরে সামনাসামনি ততটা সহজ হতো না। সেই সময়ে ছেলে মেয়েদের খোলাখুলি মেলামেশা বা গল্পকরা কি়ংবা আড্ডা দেয়া সৌজন্যমূলক ছিলোনা। সবার লাজুক চোখ কোথায় কার উপর থমকে গেছে সেই খবর কারোই জানা ছিলনা।
কিন্তু পাহাড়ি ঝর্নার মতো উচ্ছল / হরিণীর চঞ্চলতায় প্রাণবন্ত/ সূর্যের আলোর মতো তেজস্বী লিজি। সব দিকে শ্রদ্ধেয় শকুনের দৃষ্টি। কিছুই চোখ এড়িয়ে যাবার উপায় নেই। সবকিছুই ঠিক ছিলো। কিন্তু ছোটবেলায় বাবার দেয়া উপহার লাল খাতায় সব লিপিবদ্ধ করেই না যতো গন্ডোগোল।সিরাজ লিখেছে উইকিলিকসকে কে না ডরায়? সত্যি বলিতে ভয় কিসের? আমিও ডরাই। কিন্তু লাল খাতায় উলু ধরেছে। সময়ের সাথে শেষ হয়ে গেছে অনেক না জানা ইতিহাস।
কিন্তু লিজি স্বপ্ন দেখলো ষাটোর্ধ বন্ধুদের দলবলকে একত্রে কৈশোরের দিনগুলোর আড্ডায় জড়ো করার। নাতি নাতনির কাছ থেকে ক্ষনিকের ছুটিতে আমরাও পৌঁছে গেলাম সেই আড্ডায়।
ছাদে রোদে দেয়া আচারের বয়মে হাত ঢুকিয়ে যেমন অনেক লেবুর মধ্য থেকে একটি তুলে এনে ছাদের কোনায় নিরিবিলি বসে খাওয়ার মজাই আলাদা। তেমনি একবারে মাঝখান থেকে বইটি খুলে পেলাম —“সব চরিত্র কাল্পনিক”— রচনা– সিরাজুল ইসলাম। সেই সত্তরের নটরডাম কলেজ থেকে সোজা বুয়েটে অধ্যায়নরত সুদর্শন তরুণ। আজকের সুনামধন্য কথা সাহিত্যিক। সিরাজ খুব নরম কোমল স্বভাবের মানুষ । খুব কম কথা বলে —শুনে বেশি। হৃদয় হরণ করার মতো ঠোঁটের কোণে একটি হাসি সর্বদা বিরাজমান। ফর্সা সুন্দর ছটফটে সালেহ ছিল তার একান্ত বন্ধু। আমরা জমজ বন্ধু বলতে পারি। দুজনের বন্ধুত্ব সবাইকে মুগ্ধ করতো। বই মেলায় চিনতে পারে নি জেনে অবাক হয়েছি।এত তাড়া কিসের গাড়িতে ওঠার।!! একমাত্র জোড় প্রয়োজনে ছোট ঘরে যাওয়া ছাড়া অন্য কোন কারণ কি থাকতে পারে? সেটা সালেহ ই বলতে পারে।

সিরাজ—- তোমার গল্পের চরিত্র কাল্পনিক নয়। তোমার গল্পের সারিবাঁধা কালো অক্ষরের পিছু পিছু আমি আমি পৌঁছে গিয়েছিলাম সত্তরের ইডেন কলেজের মাঠে ।
আমি ঘুরে বেড়িয়েছি হ্যাপি ,নেশাত,কোয়েল ,কাক্কু আরো অনেকের সাথে।ওরা সবাই চলে গেছে না ফেরার দেশে।
কলেজের পর হ্যাপিকে আর দেখিনি। কিন্তু তোমার কাছে হেলাল ও হ্যাপির শেষ খবর জেনে বড় কষ্ট হচ্ছে।ওরা বহুদিন আগে চলে গেছে।তাদের জান্য তোমাদের রক্তক্ষরন জমাট বেঁধে থেমে গেছে হয়ত। কিন্তু আমি বুকের গভীরে উষ্ণ রক্তের ধারা অনুভব করছি।
ওরা শুধুই স্মৃতির কোঠায় বন্দি রয়ে গেলো । মনে হয় আর কয়েক বছর আগে এই আসরে গেলে হয়ত অনেকের সাথে দেখা হতো। আমার পৌঁছাতে দেরি হয়ে গিয়েছিল নাকি ওদের যাবার তাড়া ছিলো?
ইডেন কলেজে বারান্দায় আসতে যেতে কিংবা চটপটি ওয়ালার ঠেলার পাশে দেখা হতো বেলার সাথে। পঞ্চাশ বছর পর ওকে যখন পেয়েছি তখন ও ডঃ সাহেরা খাতুন বেলা। দেশের একজন নামী চিকিৎসক। কিন্তু বিনুর বাড়িতে তানপুরা হাতে ফটো তোলার পোজ দিতে যখন মাটিতে বসে গেল তখন মুহুর্তের জন্য ফিরে পেলাম সত্তরের বেলাকে।
তোমার সহধর্মিণীকে দেখার খুব ইচ্ছে ছিলো। তুমি উপহার দিলে একটি মিষ্টি বোন মুনমুনকে। এইবার বেঁচে গেলে ফিরে যাবো একবার সেই আসরে। সেদিন মুনমুনের দেয়া মায়ায় জড়ানো উপহার লাল শাড়িটা পড়বো।
বিষের নীলে বিষবিষ (2020) জর্জরিত হলেও গত ফেব্রুয়ারি ছিলো আমাদের সত্তরের কৈশোরকে হাতের মুঠোয় পাওয়ার আনন্দ। জীবনের অমূল্য প্রাপ্তি।