হাবিবুর রহমান শাহীন। স্বপ্ন দেখছেন মুক্তিযুদ্ধ বিনির্মাণের বাংলাদেশ গড়তে। সবাই যখন ব্যানার-ফেষ্টুন আর নিজের আত্মপ্রচার নিয়ে ব্যতিব্যস্ত, হাবিবুর রহমানের তখন ভিন্ন চিন্তাভাবনা। তরুণ ও আগামী প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে তুলতে শুরু করেছেন ভিন্ন রকমের প্রয়াস।
পাঠ্যপুস্তকের মুখস্ত বিদ্যা নয়, শিক্ষার্থীরা যেনো বাস্তব অবলোকন করেন সেটাই তার চেষ্টা। তার ভাষ্য, দেয়ালে আত্মপ্রচার নয়, শোভা পাবে বিখ্যাতের চিত্রকর্ম, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা, শত বছরের ইতিহাস, মনীষিদের বাণী। যেটা দেখে পথচারী থেকে শুরু করে তরুণ প্রজন্ম ও শিক্ষার্থীরা উদ্ধুদ্ধ হবেন। তবে রাজনীতি কিংবা প্রচারের জন্য নয়, মানুষের জন্য কিছু করার স্বপ্নে বিভোর তিনি। রয়েছে আরো বিস্তর পরিকল্পনা।
দেশের প্রতি নিজের ভালোবাসা প্রকাশের জন্য মানুষ কত কিছুই না করে। এই যেমন রূপগঞ্জের হাবিবুর রহমান মহান স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার জন্য নিজের বাড়ির প্রাঙ্গণে চিত্রকর্ম তৈরি করেছেন। রূপগঞ্জের কাঞ্চন পৌরসভার কেন্দুয়া গ্রাম। ছায়া-সুনিবিড় শ্যামল এলাকা। পাখির কিচিরমিচির আর শান্ত গ্রাম আপনাকে শুরুতেই মুগ্ধ করবে। তারপর যে চিত্র অবলোকন করবেন সেটা দেখেতো ভিমড়ি খাবেন। বিশাল আকারের বাড়ির দেয়ালের দু’পাশে শিল্পীর তুলির নিপুঁণ আঁচড়ে গুণীজন, মহামানব, বীরশ্রেষ্ঠদের চিত্রকর্ম দেখে অনেকটা অবাকই হবেন। রূপগঞ্জের কাঞ্চন পৌরসভার কেন্দুয়া গ্রামের বাড়িটি যেনো এখন ইতিহাস-ঐতিহ্যের গ্যালারি।
শীতলক্ষ্যা নদের কাঞ্চন সেতু থেকে নেমেই কাচারি বাড়ি। এরপরই ইতিহাসের গ্যালারি খ্যাত বাড়িটি। বাড়িটির দশ গজ দূর থেকেই চোখে পড়বে গাছে-গাছে সাটানো ছোট-ছোট নেমপ্লেটে কোরআন শরীফ ও মনীষীদের বাণী। বাড়িটির দেয়ালের দক্ষিণ পাশে বিভিন্ন মনীষীদের বাণী লেখা। লেখা রয়েছে পবিত্র কোরআন শরীফের আয়াত। রয়েছে হাদীসের বাণী। আর পূর্বপাশে জাতীয় পতাকা দিয়ে চিত্রকর্ম শুরু। পর্যায়েক্রমে রয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শরৎচন্দ্র, ঈশ্বরচন্দ্র, সিরাজদৌল্ল্যাসহ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান সাত বীরশ্রেষ্ঠসহ ৪৭ জনের চিত্রকর্ম। চিত্রকর্মে ফুটে উঠেছে বাংলাদেশের প্রাচীন ইতিহাস-ঐতিহ্য, শিল্পকলা, প্রাকৃতিক ঐতিহ্য এবং সমকালীন ইতিহাস যেমন-মহান ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালি জাতির ওপর পাকিস্তানি হানাদারদের বর্বরতা, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের কথা। বাড়ির ভেতরের বাগানের গাছে-গাছে শোভা পাচ্ছে বাণী। বাড়িটিও যেনো জাতীয় পতাকার মোড়কে সজ্জিত। বাড়ির ভেতরে তিনটি ঘর রয়েছে। তিনটি ঘরই জাতীয় পতাকার রংয়ে রাঙানো।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বাড়ির আরেকপাশের দেয়ালে চলছে ধোয়া-মোছার কাজ। এখানে বুদ্ধিজীবিদের চিত্রকর্ম অঙ্কন করা হবে। দেশের ৩৬ জন বুদ্ধিজীবির চিত্রকর্ম স্থান পাবে এখানে। পৌরসভার মাসকো স্কুলের সামনের দেয়ালে লেখা হচ্ছে পলাশী থেকে বাংলা পর্যন্ত ইতিহাস। প্রায় ৩০০ ফুট দৈর্ঘ হবে মাসকো স্কুলের সামনের ইতিহাসের গ্যালারি। বীরঙ্গনা নারী মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে রয়েছে হাবিবুরের।
দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নিজের বাড়ির খোলা প্রাঙ্গণে চিত্রকর্মের কাজ শুরু করেন তিনি। সেখানে ৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, ৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা, মাওলানা ভাসানী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সময়কার বিভিন্ন ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। আগামী প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জাগ্রত ও উজ্জীবিত করার জন্যই এই প্রয়াস বলে জানিয়েছেন হাবিবুর রহমান।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হাবিবুর রহমানের জন্মই হয়নি। ৭৫’ সালে তিনি পৃথিবীর আলো-বাতাস দেখেন। তার বয়স যখন চার তখন তিনি দেখতেন তার বাবার কাছে বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিযোদ্ধারা আসতেন। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে দেশ বিজয়ের গল্প শোনতেন। তখন থেকেই স্বপ্ন দেখতেন বড় হয়ে দেশের জন্য, মানুষের জন্য কিছু করবেন। শিল্পের নিপুণ ছোঁয়ায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি। শিল্প সত্তা হৃদয়ে গেঁথে রেখেছেন তিনি।
কেন এসব নিয়ে কাজ করতে ইচ্ছে হলো এমন প্রশ্নের জবাবে হাবিবুর বলেন, যুদ্ধের সময় আমার জন্মই হয়নি। বাবা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। যখন ছোট ছিলাম তখন দেখতাম বাবার কাছে অনেক মুক্তিযোদ্ধারা আসতেন। আমার এখনো মনে আছে মুক্তিযোদ্ধা পিনু কাকা, নুরুল ইসলাম কাকা, দেলোয়ার কাকা, নজরুল কাকা আমাদের বাড়িতে আসতেন। এসব দেখে আমার মনে দাগ কাটতো। বাবা ১৯৬১ সালে কাঞ্চন ভারত চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। ছিলেন অবনৈতিক শিক্ষক। ছোটকালেই দেখতাম বাবা সমাজসেবামূলক কাজ করতেন। আমার খুব ভাল লাগতো। তাই ওই চিন্তা থেকেই চিত্রকর্মের মাধ্যমে যুদ্ধের বিভিন্ন চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করছি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জানানোর জন্যই আমার এ চেষ্টা। যা দেখে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে পারে।
হাবিবুর রহমান আরও বলেন, আমি স্বাধীনতা যুদ্ধের অনেক গল্প শুনেছি। অনেক ইতিহাস জেনেছি। তা বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চাই। বর্তমান প্রজন্ম শুধু পাঠ্যবই থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধের ধারণা পাচ্ছে। কিন্তু তারা এ ধরনের বিনোদন কেন্দ্র এসেও স্বাধীনতা যুদ্ধের ধারণা পেতে পারে। হাবিবুর রহমানের এমন চিত্রকর্ম দেখে গ্রামের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অভিভূত হচ্ছেন।
অনেকটা ভেতরের কষ্ট থেকে হাবিবুর রহমান বলেন, দেখেন যেদিকে তাকাবেন ব্যানার, ফেস্টুন, পোষ্টার আর পোষ্টার। সবাই নিজের বা নেতার আত্মপ্রচার নিয়ে ব্যস্ত। এগুলো দেখে না কেউ কিছু শিখবে, না উদ্ধুদ্ধ হবে। সবাই যদি বিলবোর্ডে নিজেকে না লিখে এভাবে ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ বা বাণী লিখেন তাহলে সমাজ পরিবর্তন হবে।
কথা হয় চিত্রকর্ম দেখতে আসা শিক্ষার্থী বায়েজীদ বোস্তামী, আবু সাইদ, মাইমুনা আক্তারের সঙ্গে। তারা বলেন, আমরা পাঠ্যবই থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কে জেনেছি। তবে বিনোদন কেন্দ্রে থেকে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ঘটনা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পাচ্ছি। রূপগঞ্জ উপজেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুল জব্বার খাঁন পিনু বলেন, এসব দেখে শুনে মনে হবে ইতিহাসটাকে জাগ্রত করছে শাহীন। এভাবে যদি সারাদেশের একশ’টা কোনায় করা যেতো তাহলে মানুষ ইতিহাস ভুলে যতো না। এখনকার ছেলেমেয়েরা যে ধরণের লেখাপড়া করছে তাতে ইতিহাস জানার কথা নয়। শাহীন আলো ছড়াচ্ছে। এটা বৃথা যাবে না। মুক্তিযোদ্ধাদের নামফলক স্তম্ভের ভাবনাটা চমতকার। এটা গত ৪৯ বছরে কেউ করতে পারেনি।
জানা গেছে, অনেকটা নীরবে-নিভৃতে এ কর্মযজ্ঞ করে যাচ্ছেন হাবিবুর রহমান। বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর বেতনের টাকা থেকে কিছু অংশ খরচ করেন সমাজের কাজে। তাকে এ কাজে সহযোগীতা করছেন তার পিতা এস কে এম হাসমত আলী। তিনি বাড়ির বাগানের ফলফলাদি বিক্রি করে জমানো টাকা ছেলের হাতে তুলে দেন। ছোট ভাই আতিকুর রহমান জনিও তার চাকুরীর বেতনের টাকা থেকে একটা অংশ তুলে দেন বড় ভাইয়ের হাতে। আর চিত্রকর্মের পুরো কাজগুলো বিনে পারিশ্রমিকে করে দেন হাবিবুর রহমানের ভাগ্নে আল-আমিন মিয়া।
হাবিবুর রহমানের সঙ্গে কথা বলে তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার ব্যাপারে জানা গেছে। বাড়ির পাশের বাগানে ‘পথস্কুল’ নামে স্কুল করার পরিকল্পনা রয়েছে তার। তবে এখানে কোন পাঠ্যপুস্তক পড়ানো হবেনা। পথচারী আর আগন্তুক দর্শকদের জন্য করা হবে এ স্কুল। পড়ানো হবে ইতিহাস-ঐতিহ্য, মুক্তিযুদ্ধ আর মহামানবদের জীবনকাহিনী। গড়ে তোলা হবে পাঠাগার। যেখানে থাকবে মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস আর মনীষিদের জীবনী বই। রূপগঞ্জের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে ইতিহাসের গ্যালারি করার ভাবনাও রয়েছে তার। যে কাজটা স্বাধীনতার ৪৯ বছরে কেউ করেননি, সেটা করার স্বপ্ন রয়েছে তার। দুটি পৌরসভা ও ৭ টি ইউনিয়নে যারা মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন তাদের নামফলক স্তম্ভ করার স্বপ্ন রয়েছে। বীরশ্রেষ্ঠদের নিয়ে তার নিজের জমিতে বীরশ্রেষ্ঠ স্মরণী করার পরিকল্পনাও রয়েছে তার। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানিত করার পরিকল্পনাও রয়েছে তার। ইতোমধ্যে ১৮ অক্টোবর ৫১ জন মুক্তিযোদ্ধাকে সম্মাননা ও সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে তার নিজের গড়া সত্য, ন্যায় ও বিনয়ের আলোড়ন নামে সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগে।
জানা গেছে, এসব কর্মের পাশাপাশি তিনি স্কুলে-স্কুলে মেধাবী ও দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য উপবৃত্তি চালু করবেন। বয়স্ক ভাতা চালু করার ইচ্ছেও রয়েছে তার। দুঃস্থ ও অসহায় পরিবারের মেয়েদের বিয়ে দিতে না পারা পরিবারের পাশে থাকতে চান। তবে এসব কাজে তিনি পৌরসভার ট্রাষ্টি বোর্ডে অর্থ প্রদান করবেন। কোন ব্যক্তির নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকবে না। এসব কর্মযজ্ঞ শুরু করার সময় তার পৈতৃক ওয়ারিশ সূত্রে পাওয়া জমি বিক্রি করে ঐ টাকা দিয়ে শুরু করবেন বলে তিনি জানান।
কেমন করে চলছে এ কর্মযজ্ঞের খরচ। এমন প্রশ্ন শুনে অনেকটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে হাবিবুর রহমানের সোজাসাপটা উত্তর। কারো কাছ থেকে কোন টাকা-পয়সা নেইনি। একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করি। সেখান থেকে যে বেতন পাই তা থেকে সংসারের টাকা খরচ করে বাকী আয়ের টাকা এসব কাজে খরচ করা হয়। বাবা, ছোট ভাই ও ভাগ্নের সহযোগীতায় হচ্ছে এসব। বলা চলে কষ্টের টাকায় আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। সরকারী কিংবা বেসরকারী প্রতিষ্ঠান অথবা ব্যক্তিগতভাবে কেউ যদি সহযোগীতা করতে চান সেক্ষেত্রে তা গ্রহণ করবেন কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে হাবিবুর রহমান বলেন, স্বপ্রণোদিত বা স্ব-ইচ্ছায় যদি কেউ এগিয়ে আসেন সেক্ষেত্রে ভিন্ন কথা। কেউ এগিয়ে না আসলেও আমার কর্মযজ্ঞ চলবে যতোদিন বেঁচে থাকি।